‘শবে কদর’ কথাটি ফারসী। এর আরবী হল ‘লাইলাতুল কদর’। শব ও লাইলাত শব্দের অর্থ রাত। আর কদর শব্দের অর্থ মাহাত্ম্য ও সম্মান। এ রাতের মাহাত্ম্য ও সম্মানের কারণেই একে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর বলা হয়। কিংবা কদর শব্দের অর্থ তাকদীর ও আদেশ। এ রাতে যেহেতু পরবর্তী এক বৎসরের হায়াত, মওত, রিযিক প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের তাকদীর লেখা হয় (অর্থাৎ, লওহে মাহফুজ থেকে তা নকল করে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের কাছে সোপর্দ করা হয়) তাই এ রাতকে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর বলা হয়। Read in English
* লাইলাতুল কদর-এর ইবাদত হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েওশ্রেষ্ঠ। (আল-কুরআন)
* রমযান মাসের শেষ দশকের মধ্যে যে কোন বেজোড় রাতে শবে কদর হতে পারে, যেমন ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাত। ২৭শে রাতের কথা বিশেষভাবে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।
লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের গুরুত্ব
২৭শে রাতই শবে কদর হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। হাদীছে রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ
تحروا ليلة القدر في الوتر من العشر الأواخر من رمضان . (بخاری) অর্থাৎ, তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রগুলোতে শবে কদর তালাশ কর।
তাই রমযানের শেষ দশকের যেকোন বেজোড় রাতেই শবে কদর হতে পারে। বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে ২৭শে রাতও একটা বেজোড় রাত। তাই ২৭শে রাত ও শবে কদর হওয়ার একটা বিশেষ সম্ভাবনাময়ী রাত।
কোন্ রাত শবে কদর, রাসুল (সাঃ) তা নির্দিষ্ট করে বলার জন্য নিজের হুজরা থেকে মসজিদে আসছিলেন, মাঝখানে তাঁকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। মসজিদে যখন এসেছেন, তখন আর মনে নেই কোন্ রাত শবে কদর। আল্লাহ পাকের হয়তো আমাদের আগ্রহ, জয়বা দেখার ইচ্ছা যে, এত বড় একটা ফযীলতের রাত পাওয়ার জন্য আমরা একটু মেহনত করতে প্রস্তুত কি-না। তাই কয়েকটা রাতের ভিতরে শবে কদরকে ঘোরানো হয়েছে, যে কোন রাত হতে পারে, ২১শে রাতেও হতে পারে, ২৩শে রাতেও হতে পারে ২৫শে,২৭শে বা ২৯শে রাতেও হতে পারে। তাই রাসূল (সাঃ) বললেন যে, সব বেজোড় রাতগুলোতেই তোমরা শবে কদর তালাশ কর। তালাশ কর অর্থাৎ এই সব বেজোড় রাতগুলোতেই তোমরা শবে কদর পাওয়ার জন্য ইবাদত বন্দেগী ও দু’আ যা করণীয় আছে তা কর। শবে কদরের ফযীলত পাওয়ার জন্য যতটুকু যা করা দরকার, সব রাতগুলোতেই সমান ভাবে করতে বলা হয়েছে।
শবে কদরের ফজিলত ও আমল
শবে কদরের তিনটা ফযীলত রয়েছে। একটা ফযীলত কুরআনের আয়াতে বলা হয়েছে :
ليلة القدر خير من ألف شهر
অর্থাৎ, শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। হাজার মাসে ইবাদত করলে যত ছওয়াব ও যত মর্যাদা পাওয়া যায়, এই এক রাতে ইবাদত করলে তার চেয়ে বেশী ছওয়াব ও মর্যাদা পাওয়া যায়। এভাবে আল্লাহ পাক যিন্দেগীতে আগে বাড়ার কত সুযোগ করে দিয়েছেন। আগের উম্মতরা ৫০০ বছর, হাজার বছর হায়াত পেত। রাসূল (সাঃ) একবার সাহাবাদের সামনে বয়ান করলেন যে, বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তি ৫০০ বছর জেহাদে কাটিয়েছেন, কেউ এক হাজার বছর আল্লাহর ইবাদত করেছেন। এগুলো শুনে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে তড়পানি শুরু হল, তাদের ভিতরে একটা ব্যথা সৃষ্টি হল যে, তাহলে আমরাতো এত হায়াতও পাব না, এত ইবাদত করারও সুযোগ পাব না। আমরা তাহলে অন্য উম্মতের চেয়ে পিছে পড়ে যাব। তখন কুরআনের এই আয়াত নাযিল হয়েছে যে, আল্লাহ পাক তোমাদেরকে প্রতি বছর রমযানে একটা রাত্র দান করলেন, যে এক রাতে ইবাদত করলে হাজার মাসের চেয়েও বেশী ছওয়াব পাওয়া যায়। হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস হয়। এভাবে কেউ যদি যিন্দেগীতে ১২টা শবে কদর পায়, তাহলে এক হাজার বছরের সমান ইবাদত হয়ে যাবে বরং তার চেয়ে বেশী হয়ে যাবে। এভাবে আমাদেরকে অল্প মেহনতে আগের যুগের মানুষের চেয়েও আগে বেড়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই হল শবে কদরের একটা ফযীলত।
শবে কদরের আরেকটা ফযীলত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে :
من قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا ، غفر له ما تقدم من ذنبه . (متفق عليه)
অর্থাৎ, শবে কদরে ঈমানের সাথে ও ছওয়াব অর্জন করার নিয়তে যে ব্যক্তি ইবাদত করবে, তার পিছনের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। এটা অনেক বড় ফযীলতের কথা। আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেয়ে যাওয়া জীবনের অনেক বড় পাওয়া।
শবে কদরের আর একটা ফজিলত হাদীছে বলা হয়েছেঃ
إذا كان ليلة القدر نزل جبريل في كبكبة من الملائكة يصلون على كل قائم أو قاعد يذكر الله عز وجل . (رواه البيهقي في شعب الایمان)
অর্থাৎ, যখন শবে কদর হয়, তখন জিব্রাঈল (আঃ) তাঁর বাহিনীসহ অর্থাৎ, তার অধীনস্ত ফেরেশতাসহ দলবলে সারা দুনিয়ায় ঘুরতে থাকেন। আর যারা এই রাতে ইবাদত করে ও যিকির-আযকার করে তাদের জন্য রহমতের দু’আ করতে থাকেন।
শবে কদর বা লাইলাতুল কদরের দোয়া ও আমল
বোঝা গেল এই রাতে ইবাদত করলে আল্লাহর রহমতের ফয়সালা হয়। এই তিনটা ফযীলতের জন্য আমাদের তিনটা আমল করণীয় বলা হয়েছে।
দুইটা আমল হল যা এই হাদীছেই বলা হল অর্থাৎ, নামায পড়া এবং যিকির-আযকার করা।
নামায বলতে বিশেষ ভাবে নফল নামাযের কথা বোঝানো হয়েছে। তাই কদরের ফযীলত পাওয়ার জন্য নফল নামায পড়তে হবে। ইশার পর থেকে নিয়ে সুবহে সাদেক পর্যন্ত যত নফল পড়া হবে, সেটাকে নফলও বলা যায়, তাহাজ্জুদও বলা যায়। কাজেই এই রাতের ফযীলত পাওয়ার জন্য আমরা যে নামায পড়ব তা কি নিয়তে পড়ব? নফলের নিয়তেও পড়তে পারি, তাহাজ্জুদের নিয়তেও পড়তে পারি। কদরের নামায- এ কথা বলা জরুরী নয়।
শবে কদর ২০২২ কত তারিখে
দুই দুই রাকআত করে নফল পড়া উত্তম। তাই দুই দুই রাকআত করে নফল বা তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়তে থাকব। যে কোন সূরা দিয়ে পড়তে পারি, কোন সূরার বাধ্যবাধকতা নেই। এই রাতে যত নফল পড়ি, তাতে নির্দিষ্ট কোন সূরার বাধ্যবাধকতা নেই। নফল নামায় খুব আছান। শবে কদরের নামাযও নফল, এটাও খুব আছান কোন নির্দিষ্ট সূরার বাধ্যবাধকতা নেই। যেকোন সূরা দিয়ে পড়তে পারি। আমাদের সমাজে এক সময়ে মাসআলা- মাসায়েল-এর নির্ভরযোগ্য কিতাবের অভাব ছিল। তখন মকসূদুলমু’মিনীন, নেয়ামুল কুরআন বের হয়েছে, তাই মাসায়েলের কিতাব হিসেবে এগুলো জনসমাজে পরিচিত হয়ে যায়। কিন্তু এ বইগুলোলোতে অনেক গলদ। মাসআলা রয়েছে। এ জাতীয় কিতাবের ভিতরেই এরকম বলা হয়েছে যে, কদরের নামায পড়তে হবে, এত এত রাকআত পড়তে হবে এবং অমুক অমুক সূরা দিয়ে পড়তে হবে। এগুলো ভুল মাসআলা। এসব ভুল মাসআলা দিয়ে মানুষের কাছে দ্বীনকে জটিল করে ফেলা হয়েছে। মা বোনেরা অনেকে এত জটিল মনে করেন যে, কদরের নামায কি নিয়তে পড়ব, কোন কোন সূরা কতবার পড়তে হবে, কত রাকআত পড়তে হবে? এগুলি কিছুই জানি না। এভাবে তারা কদরের নামাযকে জটিল মনে করে বসেছেন। অথচ বিষয়টা জটিল নয় বরং আছান। নফল নামায পড়বেন, যে কোন সূরা দিয়ে যত রাকআত ইচ্ছা পড়বেন। কোন বাধ্য বাধকতা নেই। পড়বেন,
যাহোক শবে কদর উপলক্ষে একটা আমল হল নফল নামায। আর একটা হল যিকির করা। যা উপরোক্ত এক হাদীছ থেকেই বোঝা যায়। যিকির কি? যিকির হল সুবহানাল্লাহ আল-হামদু লিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ আকবার ইত্যাদি পড়া।
কুরআন তেলাওয়াতও একটা যিকির। আর কদরের রাতের সাথে কুরআনের একটা বিশেষ সম্পর্কও আছে। কারণ কুরআন শরীফ প্রথম নাযিল হয়েছিল কদরের রাতে। তাই এই রাতে যে যিকির-আযকার হবে তার মধ্যে বিশেষ ভাবে কুরআন তেলাওয়াতও রাখা যায়।
লাইলাতুল কদরের দোয়া
শবে কদরের তৃতীয় আমল হল দু’আ করা। দু’আর মধ্যে বিশেষ ভাবে ক্ষমার দু’আ চাইতে হবে। হযরত আয়েশা (রাযিঃ) রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন :
؟ أرأيت إن علمت أي ليلة ليلة القدر ماذا أقول فيها
অর্থাৎ, হযরত আয়েশা (রাযিঃ) রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন আমাকে বলুন যদি আমি জানতে পারি শবে কদর কোন রাত, তাহলে আমি কি বলব অর্থাৎ কি দু’আ চাইব ? রাসুল (সাঃ) বললেন তুমি বলবেঃ
اللهم انك عفو تحب العفو فاعف عنى . (ابن ماجة، ترمذی) رارت سے روند و در
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি বড়ই ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে তুমি ভালবাস, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও।
এটা হল এই রাতের বিশেষ আমল, যা রাসূল (সাঃ) শিক্ষা দিলেন সেটা হল আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
ইসলামে যতগুলি ফযীলতের সময় রয়েছে এবং যতগুলি দু’আ কবুল হওয়ার । বিশেষ মুহুর্ত রয়েছে, দেখা যায় শরীয়তে এই সব সময় এবং এই সব মুহুর্তে ক্ষমার দু’আ চাইতে বলা হয়েছে। কারণ ক্ষমা পাওয়াটাই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি কিছুই যদি না পাই, শুধু আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেয়ে যাই, তাহলে আমি কামিয়াব। পক্ষান্তরে অনেক কিছু পেলাম, স্বাস্থ্য পেলাম, চেহারা পেলাম, গাড়ী-বাড়ি পেলাম, ধন-ধৌলত পেলাম, নামী দামী আত্মীয়-স্বজন পেলাম, মান-সম্মান, পদমর্যাদা অনেক কিছু পেলাম, কিন্তু আমার ক্ষমা হল না, তাহলে আমার কিছুই হল না, তাহলে আমি ব্যর্থ, আমার জীবন ব্যর্থ। অতএব ক্ষমা পাওয়া হল সবচেয়ে বড় পাওয়া। ক্ষমা চাওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চাওয়া। তাই বড় বড় রাত্রগুলোতে, বড় বড় সময়ে এই বড় দু’আ করতে বলা হয়েছে।
অন্য যে কোন কিছু আমরা চাইতে পারি, আল্লাহর কাছে তো সবকিছুই চেয়ে নিতে হয় । হাদীছে এসেছে যে, তুমি আল্লাহর কাছে সবকিছু চেয়ে নাও। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলে তাও আল্লাহর কাছে চেয়ে নাও। এভাবে সব কিছু আল্লাহর কাছে চেয়ে নিতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তো চাওয়াটাই পছন্দ করেন। তাই যত আল্লাহর কাছে চাওয়া হয় তত আল্লাহ বেশী খুশী হন। তিনি দুনিয়ার মানুষের মত নন, আমাদের কাছে চাইলেই আমাদের বিরক্তি লাগে, আমাদের কাছে মানুষ যত চায়, তত আমাদের বিরক্তি লাগে। আর আল্লাহর কাছে যত চাওয়া হয়, ততই আল্লাহ বেশী পছন্দ করেন।
শবে কদরের আমল সমূহ
যাহোক এই রাতের তিনটা আমল
(১) নামায পড়া,
(২) যিকির করা, তার মধ্যে বিশেষ ভাবে তেলাওয়াত করা,
(৩) আল্লাহর কাছে দু’আ করা, বিশেষ ভাবে ক্ষমার জন্য দু’আ করা। নিজের ক্ষমার জন্য, সমস্ত মানুষের জন্য, যারা দুনিয়ায় বেঁচে আছেন তাদের জন্যেও, যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, বিশেষ ভাবে আপনজন যারা চলে গেছেন যেমন মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, তাদের ক্ষমার জন্য, সবার ক্ষমার জন্য দু’আ করতে হবে।
শবে কদরের তিনটা ফযীলত পাওয়ার জন্য আমরা উপরোক্ত তিনটা আমল করতে থাকি।
নফল নামায সেহরীর শেষ সময় পর্যন্ত আমরা পড়তে পারি। অনেক মা বোন সালাতুত তাসবীহ পড়তে চান। সালাতুত তাসবীহও পড়া যায়। সালাতুত তাসবীহ্ সম্পর্কে “শবে বরাত” শীর্ষক শিরোনামের আলোচনার মধ্যে বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে।
এভাবে যে কোন নফল ইবাদত করব, যিকির-আযকার করব, তেলাওয়াত করব, দু’আ করব। এই আমলগুলি ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ সব রাতেই করব। আল্লাহ পাক যেন আমাদেরকে শবে কদরের ফযীলত নসীব করেন। কদরের ফযীলত থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই।
আমাদের আজকের আলোচনাটি সম্পূর্ণ কোরআন এবং হাদিসের আলোকে সাজানো হয়েছিল। আলোচনায় শতভাগ নির্ভুল ভাবে সকল তথ্য প্রদান করা হয়েছে। আমাদের সম্পর্কে কিছু বলার থাকলে অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন।