সালাতুত তাসবীহ নামাজ এর নিয়ম

সালাতুত তাসবীহ নামাজ: সালাতুত তাসবীহ্ কথাটার মধ্যে সালাত শব্দের অর্থ হল নামায, আর তাসবীহ বলতে এখানে  (সুবহানাল্লাহি ওয়ালহাম্মদ লিল্লাহি ওয়া লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার)। এই নামাযের ভিতরে এই তাসবীহ পড়া হয়, তাই এই নামাযকে সালাতুত তাসবীহ্ বলে। Read in English

সালাতুত তাসবীহ্-এর অনেক ফযীলত। রাসূল (সাঃ) তাঁর চাচা হযরত আব্বাস (রাযিঃ) কে বলেছিলেনঃ চাচা, পারলে আপনি প্রতিদিন এই নামায পড়বেন। তা না পারলে সপ্তাহে এক দিন পড়বেন। তাও না পারলে মাসে একবার পড়বেন। তাও না পারলে বছরে একবার পড়বেন। অন্ততঃ জীবনে একবার হলেও এই নামায পড়বেন। এই নামায দ্বারা জীবনের সগীরা, কবীরা, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, নতুন, পুরাতন, গোপন, প্রকাশ্য সব রকম গোনাহ্ মাফ হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! এ নামাযের কত ফযীলত!

সালাতুত তাসবীহ নামাজ

সালাতুত তাসবীহ নামাজ এর নিয়ম

এই নামায হল ৪ রাকআত। প্রত্যেক রাকআতে এই তাসবীহ ৭৫ বার পড়তে হয়। তাহলে চার রাকআতে ৩০০ বার হয়। সালাতুত তাসবীহ্ নামাযে এই তাসবীহগুলো পাঠ করার দুইটা নিয়ম আছে। যথাঃ

নিয়ম-১ঃ

প্রথমে নিয়ত করবেন। আরবীতে না পারলে নিজের ভাষায় এভাবে নিয়ত করবেন- চার রাকআত সালাতুত তাসবীহ নফল নামাযের নিয়ত করলাম। তারপর ছানা অর্থাৎ, সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা এটা পড়বেন। অতপর সূরা ফাতিহা পাঠ করতঃ যে কোন একটা সূরা কিরাত পড়বেন। সূরা কিরাত শেষ করে ঐ দাঁড়ানো অবস্থাতেই ১৫ বার ঐ তাসবীহ পাঠ করবেন। এরপর আল্লাহু আকবার বলে রুকুতে যাবেন। রুকুর তাসবীহ পড়ার পর আবার ঐ তাসবীহ্ ১০ বার পড়বেন। তারপর রুকু থেকে উঠে রাব্বানা লাকাল হাম্দ বলার পর আবার ঐ তাসবীহ ১০ বার পড়বেন।

তারপর সাজদায় যাবেন। সাজদার তাসবীহ পড়ার পর ঐ তাসবীহ ১০ বার, সাজদা থেকে উঠে দুই সাজদার মাঝখানে ১০ বার, দ্বিতীয় সাজদায় সাজদার তাসবীহ পড়ার পর আবার ঐ তাসবীহ্ ১০ বার। এই হল ৬৫ বার। এখন আল্লাহু আকবার বলে দ্বিতীয় সাজদা থেকে উঠে বসে আবার ১০ বার। এই হল এক রাকআতে মোট ৭৫ বার। এবার দ্বিতীয় রাকআতের জন্য উঠবেন। এখানে আল্লাহু আকবার বলে উঠতে হবে না। উঠার আল্লাহু আকবার তো আগেই বলা হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় রাকআতে ঐ রকম সূরা কিরাতের পর ১৫ বার, রুকুর তাসবীহের পর ১০ বার, রাব্বানা লাকাল হাম্দ-এর পর ১০ বার, প্রথম সাজদায় ১০ বার, দুই সাজদার মাঝখানে ১০ বার, দ্বিতীয় সাজদায় ১০ বার। এরপর আল্লাহু আকবার বলে উঠবেন। এখানে আত্তাহিয়্যাতু পড়তে হবে। এখানে আগে ১০ বার ঐ তাসবীহ পড়ে তারপর আত্তাহিয়্যাতু পড়তে হবে।

মনে রাখতে হবে এই তাসবীহ সব জায়গায় স্থানীয় তাসবীহের পরে, যেমন সূরা কিরাতের পরে, রুকুর তাসবীহের পরে, সাজদার তাসবীহের পরে, রাব্বানা লাকাল হাম্দ-এর পরে, এভাবে এ তাসবীহটি সব কিছুর পরে, শুধু প্রথম বৈঠকে এবং শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার জন্য যখন বসা হবে, তখন আত্তাহিয়্যাতু-র আগে ঐ তাসবীহ ১০ বার করে পড়বেন। তারপর আত্তাহিয়্যাতু পড়বেন। শেষ রাকআতেও আগে ১০ বার পড়ে তারপর আত্তাহিয়্যাতু, দুরূদ শরীফ ও দুআয়ে মাছুরা পড়বেন।

এভাবে আমরা চার রাকআত সালাতুত তাসবীহ নামায পড়ব। এই নিয়মটা উত্তম । আর একটি নিয়ম রয়েছে। হতে পারে কেউ সে নিয়মে অভ্যস্ত তাই সে নিয়মটিও উল্লেখ করে দেয়া হল। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

নিয়ম-২ঃ

নিয়ত বেঁধেই ছানা পড়ার পর সূরা কিরাত পড়ার। আগে ১৫ বার উক্ত তাসবীহ পাঠ করতে হবে। এরপর সূরা কিরাত শেষ করে। ১০ বার। এখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দশবার বেশী হয়ে গেল। এই নিয়মে পড়লে দ্বিতীয় সাজদা থেকে সোজা দাঁড়িয়ে যাবেন। দ্বিতীয় সাজদাতেই ৭৫ বার হয়ে যাবে। এ নিয়মে প্রথম বৈঠক এবং শেষ বৈঠকে আত্তাহিয়্যাতু পড়ার জন্য যখন বসবেন, তখন আর ঐ তাসবীহ পড়তে হবে না।

তাসবীহ মনে রাখার জন্য আঙ্গুলের কর গণনা করা নিষেধ। ভাল মত খেয়াল রাখলে আঙ্গুল টিপার প্রয়োজন হয় না। একান্তই মনে রাখার প্রয়োজনে আঙ্গুল টিপে টিপে মনে রাখা যেতে পারে। কিন্তু আঙ্গুলের কর বা অন্য কোন কিছু দিয়ে গণনা করা যাবে না। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

তাসবীহ ৩০০ বার হতে হবে। কম থাকলে চলবে না। তাহলে সালাতুত তাসবীহের ফযীলত পাওয়া যাবে না। তাই খুব এতমীনানের সাথে পড়তে হবে। যদি কেউ কোন এক জায়গায় তাসবীহ পড়তে ভুলে যান বা কম থেকে যায়, তাহলে পরবর্তীতে যে জায়গায় মনে আসবে সেখানে ঐ জায়গারটাও পড়বেন পিছনের ছুটে যাওয়াটাও আদায় করে নিবেন।

সালাতুত তাসবীহ নামায একাকী পড়তে হয়-জামাআতের সাথে এই নামায পড়া দুরস্ত নয়। অনেক স্থানে মা বোনেরা জামাআতের সাথে এই নামায পড়ে থাকেন, এটা দোরস্ত নয়। অনেক স্থানে দেখা যায় একজন জাননেওয়ালী মহিলা বলে দিতে থাকেন আর অন্যরা তার কথা শুনে শুনে এই নামায পড়তে থাকেন, এটাও ঠিক নয়। এতে নামায হবে না। কোন নামাযের মধ্যেই নামাযী নন, এমন কোন লোকের নির্দেশ মেনে চলা যায় না। তাহলে নামায হয় না।

সালাতুত তাসবীহ নামাজের সূরা সমূহ

* মাকরূহ ওয়াক্ত ব্যতীত দিবা রাত্রির যে কোন সময়ে এই নামায পড়া যায়, তবে সবচেয়ে উত্তম হল সূর্য ঢলার পর পড়া, তারপর দিনে, তারপর রাত্রে। 

* যে কোন সূরা দিয়ে এই চার রাকআত নামায পড়া যায়, তবে কেউ কেউ বলেছেন, এই নামাযে সূরা আছর, কাউছার, কাফেরূন ও এখলাছ বা সূরা হাদীদ, হাশর, সফ ও তাগাবুন পড়া উত্তম।

এই চার রাকআত নামাযের নিয়ত এভাবে করা যায় আরবীতেঃ সৈন। অতি উ س در نويت أن أصلى لله ت বাংলায়ঃ চার রাকআত সালাতুত্ তাসবীহের নিয়ত করছি। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

আমরা সালাতুত তাসবীহও পড়তে পারি। অন্য যে কোন নফল পড়তে পারি। এই রাতের নফল যে কোন সূরা দিয়ে পড়া যেতে পারে। কোন কোন বই পুস্তকে লেখা আছে শবে বরাতের নামাযে অমুক অমুক সূরা এতবার করে পড়তে হবে, এটা ঠিক নয়। এরকম নির্দিষ্ট কোন সূরার বাধ্যবাধকতা নেই। নফল নামায় খুব আছান। শবে বরাতের নামাযও নফল, এটাও খুব আছান কোন নির্দিষ্ট সূরার বাধ্যবাধকতা নেই। যেকোন সূরা দিয়ে পড়তে পারি। অনেকে অমুক অমুক সূরা দিয়ে পড়তে হয় -এরকম ভুল ধারণার শিকার হয়ে এ রাতের নামাযকে কঠিন মনে করে বসেন। আসলে ওরকম কঠিন নয়।

যাহোক এ রাতে নফল নামায পড়তে হবে আর আল্লাহর কাছে দু’আ চাইতে হবে। বিশেষভাবে ক্ষমার জন্য দু’আ চাইতে হবে। ক্ষমা পাওয়ার জন্য চারটা বিশেষ শর্ত আছে। ক্ষমা পাওয়ার জন্য খাঁটি তওবা হওয়া জরুরী। খাঁটি তওবা হল চারটি জিনিসের নাম। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

image

সালাতুত তাসবীহ নামাজের তাওবা

১নংঃ জীবনে যত গোনাহ হয়ে গেছে সেই গোনাহের জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে।

২নংঃএখন ঐ গোনাহ ছেড়ে দিতে হবে।

৩নংঃভবিষ্যতে ঐ গোনাহ আর করব না মনে মনে এরকম প্রতিজ্ঞা নিতে হবে।

৪নংঃ বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে তার হক আদায় করতে হবে।

অর্থাৎ, কারও প্রতি যুলুম করে থাকলে তার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। অর্থ কড়ি হলে ফেরত দিতে হবে। যদি তার কাছে ফেরত দেয়া সম্ভব না হয়, তাকে পাওয়া না যায়, তাহলে তার আপনজনকে ফেরত দিতে হবে। যদি তার আপনজনও খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে ফেকাহ-র কিভাবে লেখা হয়েছে। তার নামে ঐ পরিমাণ অর্থ সদকা করে দিতে হবে। তাহলে এই পরিমাণ ছওয়াব তার আমলনামায় জমা হবে। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

সালাতুত তাসবীহ নামাজ

কিয়ামতের দিন সে এই ছওয়াব পেয়ে খুশী হয়ে দুনিয়াতে তার যে হক নষ্ট হয়েছিল সেটা মাফ করে দিবে। এভাবে চারটা শর্ত পূর্ণ করা হলে তখন হবে খাঁটি তওবা। খাটি তওবা হলে গোনাহ মাফ হবে। গোনাহ মাফ হওয়ার জন্যও দু’আ করতে হবে, অন্যান্য সব কিছুর জন্যও দু’আ করতে হবে। দু’আ কবূল হওয়ার যে শর্তগুলি রয়েছে, সেই শর্তগুলি পূরণ করতে হবে।

স্বাভাবিক নিয়ম হল দু’আ কবুল হওয়ার যে শর্ত রয়েছে সেই শর্ত। পূরণ না করলে আল্লাহ পাক দু’আ কবূল করেন না। দুনিয়াতেও নিয়ম হল বড় অফিস আদালতে বা শাহী দরবারে চাওয়ার বা আবেদন করার যে নিয়ম আছে, সেই নিয়ম অনুযায়ী না চাইলে আবেদন মঞ্জুর হয় না। তদ্রূপ আল্লাহ পাকের কাছে দু’আ কবূল হওয়ারও শর্ত বা নিয়ম রয়েছে। এই শর্তগুলির মধ্যে এক নম্বর এবং প্রধান শর্ত হল রিযিক হালাল হওয়া। এই প্রশ্নে আমরা অনেকে আটকে যাব।

আমাদের অনেকের রিযিক হালাল নয়। দুই নম্বর শর্ত হল মা বাপের সাথে নাফরমানী না করা। মা বাপের আনুগত্য করাও দু’আ কবূল হওয়ার জন্য শর্ত। আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার করাও শর্ত। যিকির-আযকার করে দিল তাজা রাখাও শর্ত। আত্মীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, কোন মুসলমানের সাথে অন্যায়ভাবে তিন দিনের বেশী কথা বলা বন্ধ না রাখা, হিংসা না করা, বখীলী বা কৃপণতা না করা ইত্যাদি অনেকগুলো শর্ত রয়েছে। দুআ কবূল হওয়ার জন্য এই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

সালাতুত তাসবীহ নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আল্লাহর কাছে নিজের জন্যেও চাইতে হবে। মাতা-পিতার জন্যেও চাইতে হবে। আত্মীয়-স্বজনের জন্যেও চাইতে হবে। যিন্দা, মুর্দা সকলের জন্য চাইতে হবে। সালাতুত তাসবীহ নামাজ। 

দু’আ চাওয়ার নিয়ম হল শুধু নিজের জন্য নয়; বরং সকলের জন্য চাইতে হয়। এতে আল্লাহ বেশী খুশী হন এবং ফেরেশতাদেরও দু’আ পাওয়া যায়। আমি যখন আমার আরেক ভাইয়ের জন্য কোন বিষয়ের দু’আ করব, তখন ফেরেশতারা বলবেন আল্লাহ তোমার জন্যও ওটা করে দেন। আর আমি যদি শুধু নিজের জন্য দু’আ করি, তাহলে ফেরেশতার দু’আ পেলাম না। আমার দু’আর চেয়ে ফেরেশতার দু’আ কবূল হওয়ার বেশী আশা রাখা যায়। কেননা ফেরেশতাগণ নিষ্পাপ, তাই তাদের দুআ বেশী কবূল হয়। অতএব শুধু নিজের জন্য নয় সকলের জন্য দু’আ করতে হবে।

আল্লাহ পাক সহীহভাবে আমাদেরকে এই রাতের হক আদায় করার এবং এই রাতের ফযীলত ও মর্তবা অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *