রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার তৃতীয় দিনে এসে কিয়েভের মিত্রদের টনক নড়েছে আগের দুইদিনের তুলনায় বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ। ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে যুদ্ধের অস্ত্র ও সরঞ্জাম পাঠিয়েছে ফ্রান্স। এখন সেগুলো পথে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। আর ইউক্রেনে অনুদান ও ত্রাণ দেয়াও শুরু করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এমতাবস্থায় ইউক্রেনের জন্য আবারও আশার বাণী শোনালেন ব্রিটেনের সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী জেমস হিপি। তিনি বলেছেন, যুক্তরাজ্য এবং অন্য ২৫টি দেশ আরও ‘মানবিক বা প্রাণঘাতী সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে প্রোগ্রামকে হিপি বলেন, কীভাবে সেই সামরিক সহায়তা দেয়া হবে এবং তা “ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয়া হবে সেটি ওই দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করবে ব্রিটেন। তবে এর চেয়ে বিস্তারিত জানাননি তিনি। Read in English
তিনি বলেন, ক্রেমলিন সম্ভবত ইউক্রেনের কঠোর প্রতিরোধ নিয়ে ভেবে দেখবে। এদিকে সুইফট ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ট্রান্সফার সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে সরিয়ে দেয়ার জন্য অন্যান্য দেশগুলোকে রাজি করার জন্য ব্রিটিশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি। হিপি বলেন, যুক্তরাজ্য একা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। অন্যদিকে ইউক্রেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাশিয়ার হামলায় দেশটির এ পর্যন্ত অন্তত ১৯৮ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিন শিশুও রয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন ১ হাজার ১১৫ জন।
রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেনের সাথে সীমান্ত পারাপারের আটটি চৌকির সবগুলো দিয়ে শরণার্থীদের পায়ে হেঁটে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়েছে, কারণ সীমান্ত চৌকিগুলোতে গাড়ির লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে। এর আগে পায়ে হেঁটে আসা মানুষদের শুধু একটি চৌকি, মেডিইকা দিয়ে পার হবার অনুমতি দেয়া হচ্ছিল। শরণার্থীদের জন্য নয়টি অভ্যর্থনা কেন্দ্র খোলা হয়েছে যেখানে তাদের খাদ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং তথ্য দেয়া হচ্ছে। সীমান্ত পারাপার চৌকিগুলোর কাছে স্কুল এবং জিমগুলোতে এবং প্রজেমিসল রেল স্টেশনে এই অভ্যর্থনা কেন্দ্রগুলো খোলা হয়েছে।
আলোচনায় প্রস্তুত পুতিন-জেলেনস্কি: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের শান্তি এবং যুদ্ধ বিরতি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার জেলেনস্কির প্রেস সচিব সের্গেই নিকিফোরভের বরাতে এ কথা জানিয়েছে রুশ সংবাদমাধ্যম টাস সের্গেই নিকিফোরভ তার ফেসবুক একাউন্টে লিখেছেন, আমাদের এই অভিযোগ এড়াতে হবে যে আমরা আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছি। ইউক্রেন সব সময়ই শান্তি ও যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে এবং এটি আমাদের স্থায়ী অবস্থান। আমরা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব মেনে নিয়েছি।
প্রাণ হাতে নিয়ে বহু দূর পাড়ি ৭ বাংলাদেশীর
রাশিয়ার হামলার পরপরই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে ইউক্রেনের সবাই, হাজারো মানুষের সেই মিছিলে শামিল বাংলাদেশী শিক্ষার্থী শেখ খালেদ বিন সেলিম। ওডেসা স্টেশনে তিনি সঙ্গী পান আরও ছয় বাংলাদেশী তরুণকে। ওডেসা থেকে পোল্যান্ড সীমান্তবর্তী লুভিয়েভ শহরে পৌঁছানোর গল্প শোনান তিনি। গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরপরই কৃষ্ণসাগর তীরের শহর ওডেসা থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পশ্চিম অঞ্চলের দিকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খালেদ। তিনি বলেন, “ওডেসার বাস এবং ট্রেন স্টেশন পাশাপাশি। লোকজন একটি টিকিটের জন্য মরিয়া হয়ে দুই জায়গায় ছোটাছুটি করছিল। ভাগ্যক্রমে আমি টিকিট পেয়ে যাই। স্টেশনে বাংলাদেশের আরও ছয়জন স্টুডেন্টের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।পোল্যান্ডে যাওয়া মানুষের ঢল ক্রমশ বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, মানুষের প্রচন্ড ভিড় থাকার কারণে ওইদিন ওডেসা থেকে বাড়তি একটি ট্রেন ছাড়া হয়। তারপরও অনেক মানুষ ট্রেনে উঠতে পারেনি। আমার সামনেই ভারতীয় স্টুডেন্টদের একটি দল অনেক রিকুয়েস্ট করেও ট্রেনে উঠতে পারলো না। ইউক্রেনের অনেক নাগরিকও ট্রেনে উঠতে পারেননি।
যুদ্ধ নিয়ে জনগণের চিন্তা
ওডেসার একটি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী খালেদ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, মেডিকেলে পড়তে ২০১১ সাল ইউক্রেন আসি। ২০১৪ সালে পূর্ব ইউক্রেনে (ক্রিমিয়া যুদ্ধ) যুদ্ধ শুরু হলে স্টাডি ব্রেক করে দেশে ফিরে যাই। এরপর ফিরে এসে আবার পড়া শুরু করি, এবারও যুদ্ধ। যুদ্ধ যেন আমার পিছু ছাড়ছে না। ওডেসাতে এখনও কয়েকজন বাংলাদেশী আটকা পড়ে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি ওডেসা ছাড়ার পর সেখানে মিসাইল হামলার খবর পেয়েছি। সেখানে ইউনিভার্সিটি পোল্যান্ডে শরণার্থীদের ঢল : পোল্যান্ডের সীমান্ত রক্ষা সংস্থা ও চার্চের বাংকার খুলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের ইউনিভার্সিটি জানাচ্ছে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে ইউক্রেন থেকে থেকে বলেছিল, চাইলে হোস্টেলের বাংকারে থাকতে পারি। কিন্তু আমি ঝুঁকি নিতে চাইনি। আতঙ্ক-উত্তেজনাআর ঠেলাঠেলি ইতোমধ্যেই এক লাখ ইউক্রেনীয় পোল্যান্ডে ঢুকেছে। করে ওডেসা থেকে ৭৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিবিসির এ প্রতিবেদক বলেন, শরণার্থীর ঢল বাড়ছে, শনিবার লুভিয়েভ পৌঁছায় খালেদদের ক্লান্ত দলটি কিন্তু সেখানে ভোর ছয়টা (জিএমটি) থেকে বিশ হাজারের ওপর মানুষ তাদের থাকার জায়গা নেই। কিন্তু পৌঁছেও দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে একটার পর একটা হোটেল, হোস্টেল তাদের সকলকে আশ্রয় দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পোল্যান্ড চষে বেড়ান তারা। খালেদ বলেন, এখানে মানুষ গিজগিজ সরকার। যাদের কোথাও যাবার জায়গা নেই, তাদের অস্থায়ী করছে। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে পৃথিবী শঙ্কিত
আসার পর জানতে পেরেছি, এখানেও বিমান হামলার আশঙ্কায় সাইরেন বাজানো হয়েছে। সবাই সীমান্ত পেরিয়ে পোল্যান্ড চলে যেতে চান। প্রচন্ড ঠান্ডা এখানে। থাকার জায়গা নেই। খাবারের সঙ্কটও দেখা দিয়েছে। দুই একটি বাদে বেশিরভাগ দোকান বন্ধ ব্যাংক বন্ধ, এটিএম বুথের সামনে দীর্ঘ লাইন কোথাও কোথাও বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না শুনেছি। দশ-বারো জায়গায় ঘুরে আমরা থাকার জন্য কোনোমতে একটা হোস্টেল পেয়েছি। এক রুমের মধ্যেই ছয়-সাতজন থাকতে হবে। শুক্রবার রাতে আর সীমান্তের দিকে রওনা হননি খালেদ। তিনি বলেন, পোল্যান্ড সরকার সীমান্ত খুলে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে ১৫-২০কিলোমিটার লম্বা গাড়ির লাইন পড়েছে শুনেছি । ঠান্ডার মধ্যে তাদের পথে থাকতে হবে। তাই আজ রাতে সে পথে রওয়ানা না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিয়েত থেকে বাঙালি আরো দুটি পরিবার এসেছে। তাদের সঙ্গে বাচ্চা আছে। তারা কাল সকালে (শনিবার) যাবে, আমিও তাদের সঙ্গেই যাব। যদি ভাগ্য সহায় হয়, তবে হয়ত ১০-১২ ঘণ্টায় সীমান্ত পেরুতে পালিয়ে পোল্যান্ডে পৌঁছেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে যারা পালাচ্ছেন, বাসস্থানের আশ্বাসও তারা দিয়েছে।
যুদ্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে পৌঁছাতে পারলে নাগরিকদের থাকা এবং দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়ে পরিস্থিতি দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন খালেদ। জাতিসংঘের প্রস্তাবে রাশিয়ার ভেটো, চুপ ভারত-চীন। ইউক্রেনে চলমান রুশ হামলা ঠেকাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক খসড়া প্রস্তাবে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে রাশিয়া। আর ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে চীনসহ ৩টি দেশ। গত শুক্রবার উত্থাপিত এই খসড়া প্রস্তাবে ইউক্রেনে চালানো রুশ আগ্রাসনের কড়া ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আলবেনিয়া যৌথভাবে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ দেশের মধ্যে ১১টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর ভোট দানে বিরত ছিল ৩ টি দেশ। দেশগুলো হলো- চীন, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে মস্কোর ভেটো ক্ষমতার কারণে এই প্রস্তাবটিও ব্যর্থ হয়েছে। তবে শুক্রবার এই খসড়া প্রস্তাব পাস না হওয়াকেও নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে পশ্চিমা দেশগুলো।