বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৭ ই মার্চের সম্পূর্ণ ভাষণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৭ ই মার্চের সম্পূর্ণ ভাষণ : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোছাম্মদ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান বাবা-মা ডাকতেন খোকা বলে খোকার শৈশবকাল কাটে টঙ্গী পাড়ায়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ আমরা খুঁজে থাকি। আজ আমি আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের পূর্ণাঙ্গ ভাষণ। Read in English
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্ঠে ভাষণ বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিল ১৮ মিনিট স্থায়ী এই ভাষণে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের কে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। এ ভাষণ কে স্বীকৃতি দিয়ে মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার (এমওডব্লিউ) তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এম ও ডব্লিউ কে এটা প্রথম কোন বাংলাদেশী দলিল আনুষ্ঠানিক স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হবে। বারোটি ভাসানী ভাষণটি অনুবাদ করা হয় ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ ঢাকার রমনা অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ টি আমাদের ওয়েবসাইটে হুবহু প্রকাশ করা হলো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ৭ ই মার্চের সম্পূর্ণ ভাষণ
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি আজ ঢাকা চট্টগ্রাম রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায় তারা অধিকার পেতে চায় নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করব এবং ওই শাসনতন্ত্রের মানুষ তাদের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে।
কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমুর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুন ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশের সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দেয়া হলো এবং এরপর এ অপরাধে আমর বহু ভাইকে হত্যা করা হলো। হাজার 969 সালের গণনা এর মুখে আইয়ুবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।

তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো-আমরা তাকে ১৫ ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি’ পার্টির নেতা হওয়া সত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টো সাহেব বললেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে, তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন।
আমি বললাম তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নিব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।জনাব ভুট্টো ঢাকায় এসেছিলেন। তার সঙ্গে আলোচনা হল। ভুট্টো সাহেব বলে গেলেন আলোচনার দরজা বন্ধ নয় আরো আলোচনা হবে। মাওলানা নূরানী ও মুফতি মাহমুদ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হল উদ্দেশ্য ছিল আলাপ-আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনার করব। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি ছয় দফা পরিবর্তনের কোনো অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ। কিন্তু ভূট্টু হুমকি দিলেন। তিনি বললেন এখানে এসে ডবল জিম্মী’ হতে পারবেন না।
পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেওয়া হবে। হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত। একটি দোকান খুলতে দেওয়া হবে না।
তা সত্বেও পয়ত্রিশ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য এলেন। কিন্তু পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে দোষ দেওয়া হলো আমাকে বলা হল আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু হয়নি।
এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য হরতাল ডাকলাম জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো।
কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলা নিরস্ত্র মানুষের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে সে অস্ত্র কিনে দিয়েছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আসছে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আমর দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলি। আমার বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি, তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে-আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ইয়াহিয়া খান বলেছেন আমি নাকি ১০ ই মার্চ তারিখে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি। তার সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাকে বলেছি আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, ঢাকায় আসুন দেখুন আমার গরিব জনসাধারণকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে।
আমি আগেই বলে দিয়েছি কোন গোলটেবিল বৈঠক হবে না। কিসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোল টেবিল বৈঠক? যারা আমার মা বোনের কোল শূন্য করেছে তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে? তেসরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযোগের আহব্বান জানালাম। বললাম অফিস-আদালত, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন।
হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো কিন্তু গুলি করে মারা হলো আমার বাংলার মানুষকে। আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের, আমরা বুলেট খাই দোষ আমাদের।

ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্ত আমার দাবী সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসবো না। এ দাবি মানার আগে পরিষদে বসার কোন প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহীদদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যোগ দিতে যাব না।
ভাইয়েরা, আমার উপর বিশ্বাস আছে? আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি, ফাঁসির কাঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো; মনে আছে? আজ আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট,কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমুহ অনির্দিষ্ট-কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোন কর্মচারী অফিস যাবেন না। এ আমার নির্দেশ। গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে।
ট্রেন চলবে তবে সেনাবাহিনী আনা-নেয়া করা যাবে না। করলেন যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো না।
সেক্রেটারীয়েট সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্ট জজকোর্ট সহ সরকারি আধাসরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ববাংলার আদান-প্রদানের ব্যাঙ্কগুলো দু-ঘন্টার জন্য খোলা থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঢাকা যেতে পারবে না। টেলিগ্রাফ টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। তবে সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।
এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি একটিও গুলী চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলবেন। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবো-পানিতে মারবো। হুকুম দিবার জন্য আমি যদি না থাকি আমার সহকর্মীরা যদি না থাকেন, আপনারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবীয়ে রাখতে পারবা না। বাঙ্গালী মরতে শিখেছে, তাদের কেউ থামাতে পারবে না। শহীদদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্য চেষ্টা করব। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন।
সাত দিনের হরতালে যেসব শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি-শিল্প মালিকরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন। আন্দোলন কিভাবে করতে হয় আমি জানি।
কিন্তু হুশিয়ার একটা কথা মনে রাখবেন আমাদের মধ্যে শত্রু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকহলের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি ও বাঙালি হিন্দু মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোন বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না।
শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রস্তুত থাকবেন ঠান্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। শৃঙ্খলা ছাড়া কোন জাতি সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারবে না।
আমার অনুরোধ প্রত্যেক গ্রামে মহল্লায় ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
“এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”
জয় বাংলা।”